উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভিটে
: ময়মনসিংহের এক পুরনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল একটা শান্ত, অবিকল বাংলার মতোই সরল এক বাড়ি। রায়চৌধুরী পরিবারের সেই ভিটেবাড়ি—যেটা শুধু একটা বাড়ি নয়, একটা সময়, একটা গল্প, একটা ইতিহাস। সেই বাড়িটা আজ আর নেই। ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আর সেই খবরে বুকের ভিতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী—ছোটবেলার সেই পরিচিত নাম, যার লেখা পড়ে বড় হয়েছি আমরা। যাঁর হাত ধরেই বাংলা শিশুসাহিত্য পেয়েছিল নতুন এক দিশা, যাঁর ছায়ায় গড়ে উঠেছিল সত্যজিৎ রায়ের মতো মহীরুহ। সেই মানুষটার স্মৃতি যেখানে জড়িয়ে ছিল, সেই বাড়িটাই এখন আর থাকবে না। এটা শুধু একটা দালান ভাঙা নয়, মনে হচ্ছে যেন আমাদের ইতিহাসের একটা অংশ ভেঙে মাটিচাপা পড়ে গেল।
জানেন, উপেন্দ্রকিশোর যখন ছোট ছিলেন, তখন তাঁর নাম ছিল কামদারঞ্জন। হরিকিশোর রায়চৌধুরী নামে এক জমিদার তাঁকে দত্তক নেন। তখনকার দিনে সেটাই ছিল ভালবাসার এক অনন্য রূপ। আর সেই হরিকিশোরের দেওয়া নতুন নামেই কামদারঞ্জন হয়ে ওঠেন উপেন্দ্রকিশোর। এই বাড়ির প্রতিটা ইটে ছিল সেই ভালোবাসার, সেই শেকড়ের গন্ধ। কিন্তু এখন সেই গন্ধটাও উবে যাচ্ছে ধুলোয়।
প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছে, বাড়িটি নাকি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। শিশুদের জন্য ঝুঁকি ছিল। তাই নিয়ম মেনেই নতুন আধা-কংক্রিটের ভবন তৈরি করা হচ্ছে। তাতে ঘর থাকবে, অ্যাকাডেমির কাজ চলবে। হয়তো হবে, হয়তো শিশুরা পড়াশোনা করবে, খেলবে। কিন্তু ওদের কীভাবে বোঝানো যাবে—তোমাদের যে মাটিতে দাঁড়ানো ভবন, সেটা একদিন এক মহান গল্পকারের স্মৃতিভূমি ছিল?
ভারতের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কষ্ট পেয়েছেন, তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, “এই বাড়ি বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। রক্ষা করুন এটা।” কিন্তু কেবল একজন মুখ্যমন্ত্রীর নয়, আমাদের প্রত্যেকের, সাধারণ পাঠকের, এই বাংলাভাষার প্রেমিকদেরও কিছু বলার ছিল। আমরা চুপ করে থাকলাম।
আমরা কি এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি উন্নয়নের খোলস গড়তে যে পুরোনো জিনিসগুলোকে শুধুই ‘ঝুঁকিপূর্ণ কাঠামো’ হিসেবে দেখতে শিখে গেছি? আমরা কি ইতিহাসের কদর হারিয়ে ফেলেছি?
যদি সেই ভিটেটা একটু ঠিক করে, একটু সাজিয়ে, ছোট একটা সংগ্রহশালা বানিয়ে রাখা যেত—তাহলে শিশু অ্যাকাডেমিরও হতো, আর ইতিহাসও বাঁচত। হয়তো ওখানে দাঁড়িয়ে কেউ একজন নিজের ছেলেমেয়েকে বলত, “দেখো, এখানেই থাকতেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সন্দেশ পত্রিকা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল…”
কিন্তু আমরা সেটা আর কখনও দেখতে পারব না। এখন থাকবে একটা নতুন বিল্ডিং, কংক্রিটের দেয়াল আর স্টিলের জানালা। আর থাকবে না সেই নরম আলো, পুরনো কাঠের গন্ধ, বা অতীতের সঙ্গে সংযোগ।
সবকিছু ঠিকঠাক হলেও, ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে—এই ভাঙাগুলো শুধু ইটের নয়, এগুলো আমাদের শেকড়ের, আমাদের অনুভূতির, আমাদের স্মৃতির।
ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে গেলে, পেছনে থাকা দরজাটা খোলা রাখতে হয়। আমরা কি সেই দরজাটা নিজেই বন্ধ করে দিলাম?